দেশনেত্র ডেস্ক:
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে নতুন সরকারের পুনর্গঠিত মন্ত্রিসভার কার্যক্রম ইতোমধ্যে পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। নতুন মন্ত্রীদের অল্প কদিনের সচল কার্যক্রমের মাধ্যমে আপাতত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর হলেও তা দিয়ে সংকটাপন্ন অর্থনীতির চেহারার এখনো বদল ঘটানো সম্ভব হয়নি। যদিও অর্থনীতিতে এখন নতুন অভিভাবক মিলেছে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন নতুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
যেই মুহূর্তে তিনি এই দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন, তখন দেশের অর্থনীতি নানামুখী চক্রাকার সমস্যার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। এই সংকট উত্তরণের নতুন রোডম্যাপ কী হবে, কবে নাগাদ তার সুফল মিলবে? আগের সরকারের আমলে নেওয়া পদক্ষেপগুলোই তার আগামী কর্মপরিকল্পনায় সংকট মোচনের পাথেয় হবে কি না, এর কোনো কিছুই এখনো পরিষ্কার হয়ে ওঠেনি।
সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, অর্থনীতির বিদ্যমান সমস্যাগুলো অনেক পুরোনো, যা কাটিয়ে উঠতে আগে থেকেই অনেক পদক্ষেপ বাস্তবায়নাধীন, যদিও সেসব পদক্ষেপের মধ্যে অল্প কিছু পয়েন্ট বেসিসের মূল্যস্ফীতি কমে আসার লক্ষণ ছাড়া, অন্য কোনো দৃশ্যমান সুফল অর্থনীতিতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এখন নতুন অর্থমন্ত্রী আগের পদক্ষেপগুলোর ধারাবাহিকতা ধরে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন কী সংযোজন ঘটাবেন, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
যদিও দায়িত্ব নেওয়ার পর সামগ্রিক অর্থনীতি নিয়ে তিনি গণমাধ্যমে কথা বলেছেন খুবই কম। মন্ত্রণালয়ে একাধিক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রশ্নের পর প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হলেও তার যথার্থ উত্তর আসেনি। বলেছেন, ‘খুব মেপে মেপে এবং অতি অল্প কথায়। অনেকটা দেখছি, ‘দেখা যাক’, ‘আমরা কাজ করছি’। ‘একটু বুঝি, সময় দেন’, ‘আমরা সফল হব’ ইত্যাদি ধরনের মন্তব্য। দেশের অর্থনীতির গতিপথ পরিবর্তনের কৌশল প্রয়োগের বিষয়ে এখনই তিনি কিছু জানাতে চান না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে একাধিক বৈঠক শেষে কালবেলার এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী শুধু জানিয়েছেন, মাত্র তো এলাম। একটু বুঝতে দেন। আগে কাজটি করতে দেন। একটু সময় দেন। অর্থাৎ অর্থনীতির চলমান সংকট মোচনের কাজটি তিনি করতে চান ধীরে ধীরে, বুঝেশুনে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, একদিকে দেশের আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার উপক্রম। ব্যাংকে ব্যাংকে তারল্য সংকট। ধার দিয়ে অনেক ব্যাংককে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। খেলাপি ঋণের হার উদ্বেগজনক। আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্ষদ নিয়েও রয়েছে সীমাহীন অভিযোগের তীর। এই যখন অবস্থা, তখন সামষ্টিক অর্থনীতির চিত্রও নেই স্বস্তির জায়গায়। ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন। নানা পদক্ষেপেও দূর করা যাচ্ছে না ডলার সংকট। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি বা রিজার্ভের ক্ষয়িষ্ণু দশাও কাটেনি, বরং ধারাবাহিক ঘাটতির কারণে ইতোমধ্যে দেশে বহুমুখী সংকট তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে নিত্যপণ্য আমদানি ছাড়া অন্যান্য আমদানিতে চাহিদানুযায়ী ডলার সরবরাহ মিলছে কম।
আবার দাতা সংস্থাগুলোর বৈদেশিক ঋণের আগের ৫ মাসের তুলনায় গত ডিসেম্বরে দ্বিগুণ অর্থ ছাড় হলেও সেটি রিজার্ভের ঘাটতি পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারছে না। যে পরিমাণ অর্থ ছাড় হচ্ছে, এই দিয়ে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রার চাহিদাও পূরণ হচ্ছে না। অনুদানের দরজাও প্রায় বন্ধ। অন্যদিকে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর হার বাড়লেও সে অনুযায়ী প্রবাসী আয় আসছে কম। রপ্তানি আয় এখনো প্রবৃদ্ধির মধ্যে থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন থেকে অনেক দূরে। তদুপরি নতুন সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে লোহিত সাগরে হুতি বিদ্রোহীদের হামলার আতঙ্কে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পণ্যবাহী জাহাজের গতিপথ পরিবর্তন। ফলে কনটেইনারপ্রতি বাড়তি গুনতে হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ ডলার। এতে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানির নিট আয় কমে আসার সমূহ শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার পদক্ষেপও হিতে বিপরীত ফল দিচ্ছে। সব মিলে লাগামহীন মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য এখন নীরব ঘাতক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সবচেয়ে বড় আতঙ্কের বিষয় হলো, সরকারের স্বনির্ভরতার মূল নিয়ামক রাজস্ব আদায়েও নেই গতি। বরং অর্থবছরের ৬ মাসের হিসাবে এরই মধ্যে ঘাটতি বেরিয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
সব মিলে সামষ্টিক অর্থনীতি এমন পর্যায়ে নেমে এসেছে, যেখানে খোদ সরকারকেই এখন রাজস্ব নীতির সঙ্গে মুদ্রানীতির সাংঘর্ষিক পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে কোনো লক্ষ্যই সঠিকভাবে অর্জিত হচ্ছে না। একদিকে রাজস্ব আয়ে ধস নামার পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রবাহেও দেখা দিয়েছে তথৈবচ অবস্থা। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়নের উদ্যোগও গতি হারাতে বসেছে। সংকুচিত হয়ে আসছে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র। এসবের যোগফল মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিকেও এখন তলানিতে নামিয়ে এনেছে।
সার্বিকভাবে জনতুষ্টি বজায় রেখে অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়ার যে বাজেট রয়েছে, চলতি অর্থবছরে এর অধিকাংশ সূচকের লক্ষ্য অর্জন এখন ঝুঁকির মধ্যে। এ অবস্থায় সংকটাপন্ন অর্থনীতির হাল ধরতে নেমে ওইসব পদক্ষেপের সঙ্গে কী নতুন ম্যাজিক কৌশল দেখাবেন অর্থমন্ত্রী? এই নিয়ে ন্যূনতম অর্থনীতি বুঝেন—এমন সাধারণেরও কৌতূহলের শেষ নেই।
অর্থমন্ত্রীর ম্যাজিক কৌশল জানতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন উইংয়ে বেশ কিছুদিন যোগাযোগের চেষ্টা করেছে কালবেলা। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘আসলে অর্থনীতির বিদ্যমান সংকট সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বেশ ওয়াকিবহাল। তা ছাড়া সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে উত্তরণের অংশ হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় আগে থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক-এনবিআরসহ বিভিন্ন অংশীজনের নিয়ে পরিকল্পিত রোডম্যাপ নিয়ে কাজ করে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় বৈদেশিক ঋণ, মুদ্রানীতি, মুল্যস্ফীতি, ডলার বাজার, রাজস্ব খাত, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় সর্বোপরি চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে একের পর এক কাজ চলমান। এখন নতুন অর্থমন্ত্রীর সংকট মোচনের পদক্ষেপে আরও নতুন কিছু সংযোজন হয়তো হবে। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর, এনবিআর চেয়ারম্যান, অর্থ সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবসহ বিভিন্ন ব্যাংকের প্রধানদের সঙ্গে দফায় দফায় বসে শলাপরামর্শ করেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, খাদ্য ও শিল্পায়ন, জলবায়ুসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের গৃহীত পদক্ষেপের সম্পৃক্ততা এবং তার ফলাফল দেখছেন। একই সঙ্গে তিনি বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেছেন। সামনে আরও আলোচনা হবে। এসবের ভেতর দিয়ে চলমান পদক্ষেপ বা কর্মসূচিগুলোর হালনাগাদ ফলাফল সমন্বয় করে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন। সেখানে আগে নেওয়া হয়নি এমন অভিনব কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপও আসতে পারে, যা সময় হলেই সবার কাছে স্পষ্ট হবে।
অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় জানান, ‘অর্থনীতির বিদ্যমান বাস্তবতা বলছে, এই মুহূর্তে সংকট মোচনের কোনো ম্যাজিক কৌশল অর্থমন্ত্রীর হাতে নেই। সেটি সম্ভবও নয়। আবার আগের পদক্ষেপগুলো এড়িয়ে সংকট উত্তরণের আরও নতুন কোনো কৌশল আছে বলেও আমি মনে করি না। কারণ, অর্থনীতির টুলসগুলো ব্যাকরণ মেনে চলে। সেখানে উদ্যোগ ছিল। অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি। নতুন অর্থমন্ত্রীকে সেই কাজের কাজটিই সুচারুভাবে করতে হবে। এর জন্য কিছুটা সময় তো অবশ্যই দেওয়া দরকার।
এক প্রশ্নের জবাবে এই অর্থনীতিবিদ অর্থমন্ত্রীর প্রতি পরামর্শ রেখে বলেন, আর্থিক খাত (ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান), রাজস্ব খাত (শুল্ক-কর ও ভ্যাট), সার্বিকভাবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট, মুদ্রাবাজার) নিয়ে খাতভিত্তিক বিশেষজ্ঞ ও সরকার প্রতিনিধির সমন্বয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পৃথক পৃথক কমিটি গঠন করা জরুরি। এ কমিটির চেয়ারম্যান হতে হবে সর্বজনস্বীকৃত বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। যার তত্ত্বাবধানে গঠিত কমিটি ওই খাতের পোস্টমর্টেম করে প্রতিবেদন দেবে। অর্থমন্ত্রী সেই সুপারিশের আলোকে আগামীদিনের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন উদ্যোগ নিলে অর্থনীতির চলমান সংকট মোচন সম্ভব, যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই রূপ পাবে অর্থনীতি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, অর্থমন্ত্রীর সামনে এখন অনেক কাজ। সব কাজ তিনি একসঙ্গে সারতে পারবেন না। অগ্রাধিকার নির্ধারণের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক কিছু উদ্যোগ জরুরি, বিশেষ করে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফেরাতে সবার আগে নজর দেওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ডলারের সংকট দূরীকরণের উদ্যোগে আরও গতি বাড়িয়ে তার কঠোর প্রয়োগে যাওয়া জরুরি। এর সঙ্গে চলতি বাজেটের লক্ষ্যমাত্রাগুলো বাস্তবায়ন হবে না, সেটি এরই মধ্যে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখন এই বাজেটের যৌক্তিক সংশোধন ও সময়ের বাস্তবতায় আগামী বাজেটের নতুন কলাকৌশল নির্ধারণে মনোযোগী হতে হবে। তাহলে অর্থনীতি নিয়ে সরকারের চাপ অনেকাংশে কমে আসবে। এ ছাড়া আর্থিক খাত সংস্কার এবং রাজস্ব আদায় বাড়াতে কিছু উদ্যোগ মধ্যমেয়াদি এবং কিছু দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ধরে অর্থমন্ত্রীকে কাজ করতে হবে। যেসব পদক্ষেপ এরই মধ্যে বাস্তবায়নাধীন, সেগুলোতে যদি কোনো জটলা থাকে তা ঝেড়ে ফেলতে হবে। বিশেষ করে অর্থনীতিকে নিরাপদ রাখতে হলে আর্থিক খাত সংস্কারে নতুন অর্থমন্ত্রীকে জোর দিতেই হবে।