“নলেন পাটালির শৈশব”

“নলেন পাটালির শৈশব”

নিপুল কুমার বিশ্বাস :

চারিপাশে শীতের আমেজ।এই শীতে গ্রাম বাংলায় অনেক জায়গায় প্রকৃতির বিভিন্নরুপ দেখতে পাওয়া যায়। ভিন্নরুপের শীতে যশোর জেলার অনেক এলাকায় খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় ও পাটালি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যায় শত শত গাছিকে।
শীতের মৌসুমে মৌমাছি যেমন সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে ঠিক তেমনি গাছিরা ব্যস্ত খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করে পাটালি ও গুড় তৈরিতে। ইট পাথরের শহরে, শীতের আগমনী বার্তায় বাবা ও ছেলের সাথে সকালে খাবার টেবিলে বসে নাস্তা করতে করতে মনে পড়ে শীতের দিনের শৈশবের দিনগুলি ।

শীতের শুরুতে খেজুর গাছ গুলির একপাশের ডেগো ও ফাতরা (আঞ্চলিক ভাষায়) পরিষ্কার করে গাছ থেকে রস সংগ্রহের উপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়। এই ফাতরা দিয়ে আগুন বাজি তৈরি করে, সন্ধ্যা হলে এই আগুন বাজিতে আগুন জ্বালিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অন্ধকারে কি আনন্দই না করেছি।

দুপুরের পর পড়ন্ত বিকালে গাছিরা থেজুরের গাছ কেটে মাটির ভাড় (কলস) বেঁধে রাখে। মাটির পোড়ানো ভাড়ে সন্ধ্যার দিকে যে রস জমা হয় এটাকে বলে সন্ধ্যার জিরেন রস। এই জিরেন রস খেতে শৈশবে পাট কাঠির নল তৈরি করে খেজুর গাছের মাথায় উঠে ভাড় থেকে কতদিন যে সন্ধ্যার জিরেন রস খেয়েছি তার ইয়ত্বা নেই। কখনও মনে হয়নি নিপা ভাইরাসের কথা অথবা গাছ থেকে পড়ে যাওয়া চিন্তা। আর শহরে বসে অনলাইনের সুবাদে কোথাও থেকে এক লিটার রস সংগ্রহ করে বাসায় গেলে সন্তানেরা তো খাই না আবার ভয় দেয় নিপা ভাইরাসের।

রাতে এই রস ঝেড়ে এনে ঝুনা নারিকেল কুরানি দিয়ে কুরে নারিকেল পাটালি বানানো হতো। পাটালির মধ্যে নলেন গুড়ের পাটালির এক অন্য রকম স্বাদ ও সুঘ্রাণ থাকত। যে না খেয়েছে সে বুঝবে না এর স্বাদ। হয়তো পাটালি বুঝবে কিন্তু নলেন গুড়ের পাটালি কি জিনিস সেটা বুঝবে না। রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করে বিচ মেরে গুড়ের সাথে মিশিয়ে কড়াই বা তাপালে (তাওয়া— দৈর্ঘে্য প্রস্তে তিন—চার ফুট লম্বা টিনের সিড দিয়ে তৈরি) জমে যাওয়ার পূর্বমূহুর্তে কলা পাতায় বা কুলার উপর কাপড় বিছিয়ে অথবা থালার উপর জমিয়ে তৈরি করা হয় পাটালি। নলেন গুড়ের পাটালি খেজুর গাছের রস আহরণের প্রথম দিকের রস জ্বালিয়ে বানানো পাটালি। নারিকেল পাঠালি, তিলের পাটালি, বাদাম পাটালি হরেক রকমের পাটালি তৈরি করে গাছিরা। নারিকেল পাটালি সবচেয়ে বেশি সুস্বাদু। হাতে নলেন গুড়ের পাটালি আর খুচিতে সদ্যভাজা মুড়ি আত্নীয় বেড়াতে আসলে এটাই ছিল শীতের সময়ের গ্রাম বাংলায় মেহমানদের আপ্যায়নের প্রধান ও খুব জনপ্রিয় খাবার ।

সারা বছরের পিঠা পায়েশ তৈরিতে খেজুর গুড়ের জুড়ি মেলা ভার। তেতুল গুড় নামে আরেক উপদান তৈরি করা হতো যাহা মেহমানদের চিড়া, মুড়ি, নারিকেল কুরার সাথে তেতুল গুড় যাহা দইয়ের বিকল্প ব্যবহার করা হতো।
ভাড়ে খেজুরের রস ভরে, মাটির নিচে দশ পনের দিন রেখে, মাঝে মধ্যে, মধ্য রাতে পান করে, মাতাল হয়ে কারো খড় বা বিচালির গাদায় আগুন লাগানো দক্ষিন ও পশ্চিম পাড়ার কয়েক জনের ছিল নিত্যস্বভাব। ধরা পড়ার পর ঘুম ঘুম চোখে অপরাধ স্বীকার করে কারো নামে ফিরিস্তি বলতে বলতে বাড়ি চলে যেত।
কড়াই বা তাপালে গুড় তৈরির পর, গুড় মাটির লম্বা ভাড়ে সংগ্রহ করার পরে তাপালে থাকা গুড়ের মাঝে মুড়ি ঢেলে দিয়ে একসাথে চার—পাঁচ জন বাল্যবন্ধু মিলে খাওয়ার যে আনন্দ ছিল শৈশবে, তাহা যেন বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের পার্টির আয়োজন থেকেও শতগুণ উত্তম ও আনন্দের। যাহা এই প্রজন্মের সন্তানেরা কোন দিন অনুভব করতে পারবে না।
আর শীতের সকালে গাছ থেকে ঝেড়ে আনা সকালের জিরেন রস গ্লাসে নিয়ে সাথে মুড়ি দিয়ে সেবন করার যে তৃপ্তি, তা বর্তমানে নাই উপভোগ করলাম এই ইট পাথরের শহরে।

নিপুল কুমার বিশ্বাস , ঢাকা 
biswasnipul14@gmail.com

এছাড়াও

আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, ৭৩ টি ভাষায় ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ

আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, ৭৩ টি ভাষায় ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ

ভালোবাসা শব্দটা উচ্চারণ করলেই যেন কেমন একটা অন্যরকম অনুভূতি জাগে মনের ভিতরে। কি মধুর শিহরণ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *